রফিকুল ইসলাম, প্রতি বছরই উপকূলে আঘাত হানছে কোননা কোন ঘূর্ণিঝড়। লন্ডভন্ড করে দিচ্ছে পটুয়াখালীর বিচ্ছিন্ন দ্বীপ উপজেলা রাঙ্গাবালীকে। ঘরবাড়ি হারিয়ে নিস্ব হচ্ছে হাজার হাজার পরিবার। তবুও টনক নড়ছেনা সংশ্লিষ্ট কতৃপক্ষের। এখনো নির্মাণ হয়নি টেকসই বাঁধ আর পর্যাপ্ত সাইক্লোন শেল্টার। ঘূর্ণিঝড় এলে সবাই নড়েচড়ে বসলেও কিছু দিন পর কেটে যায় রেশ। আলোচনার বাইরে থাকে অরক্ষিত উপকূল। আর এ কারণেই প্রতিবারের ঘূর্ণিঝড়ে মানুষের জানমালের ক্ষয়ক্ষতি হয় অপূরনীয়। যা এবারের ঘূর্ণিঝড় রেমাল চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে গেছে। ঘূর্ণিঝড় রেমাল কেটে গেছে। জলচ্ছ্বাসের পানিও নেমে গেছে। তাতেই কি নিরাপদ উপকূবাসী?
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, উপকূলের বিধ্বস্ত বেড়িবাঁধ দ্রুত সময়ের মধ্যে পুন: নির্মাণ না করা হলে অদূর ভবিষ্যতে কোন ঘূর্ণিঝড় আঘাতহানলে প্ররিস্থি হতে পারে আরো ভয়াবহ।
সুপার সাইক্লোন সিডরের পর সবচেয় বেশি তান্ডব চালায় ‘রেমাল’ গত ২৬ মে রাতে আঘাতহানে অতিপ্রবল এ ঘূর্ণিঝড়। প্রচন্ড ঢেউয়ের তোড়ে বিভিন্ন স্থানে ভেঙ্গ যায় বেড়িবাঁধ। জলোচ্ছ্বাসে প্লবিত হয় উপজেলার চর আন্ডা, মোল্লা গ্রাম, নয়াচর, বউ বাজার, চালিতাবুনিয়া, মাঝের চর, চর কানকুনি ও কাউখালী চর সহ বেশ কয়েকটি বিচ্ছিন্ন দ্বীপ। হুহু করে পানি ঢুকে লন্ডভন্ড হয়ে যায় মানুষের বাড়ি-ঘর। বাস্তুহারা হয়ে পরে হাজারো মানুষ।
জেলা প্রশাসন সূত্রে জানাগেছে, ঘূর্ণিঝড়ে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ এলাকা রাঙ্গাবালী। শুধু এ উপজেলাতেই ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ১১৫ কোটি ৯০ লাখ টাকা। ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে ১৪ হাজার বাড়ি-ঘর। এমধ্যে সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত দেড় বাড়ি-ঘর। ভেসে গেছে দেড় হাজারেরও বেশি মাছের ঘের ও পুকুর। ক্ষতি হয়েছে ৬ কোটি ৫০ লাখ টাকা। মারা গেছে ৫৭৭টি গবাদিপশু। সব মিলিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের সংখ্যা ৪৮ হাজার ৩০০।
উপকূলেরবাসীর দাবী, টেকসঁই বেড়িবাঁধ নির্মাণ না করায় প্রতিবছরই কোননা কোন ঘূর্ণিঝড় আঘাত হেনে লন্ডভন্ড করে দেয়। এক দুর্যোগের ধাকল না কাটতেই আরেক দুর্যোগ এসে তছনছ করে দেয়। আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে কেউ কেউ এখন সব হারিয়ে নিস্ব। বাস্তুহারা হাজার হাজার মানুষ। নতুন করে ঘর সাজানোর অর্থও নেই তাদের। খোলা আকাশের নিচে বসবাস করছেন অনেকেই। তাই এবার শুধু ত্রাণ নয়। টেঁকসই বাঁধ ও পর্যাপ্ত সাইক্লোন সেল্টার চান তারা।
গত ৩০ মে ঘূর্ণিঝড় দুর্গতদের দেখতে পটুয়াখালীর কলাপাড়ায় হেলিকপ্টারে করে আসেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এর পরদিন রাঙ্গাবালীর যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন দ্বীপগুলোতে স্পীডবোট নিয়ে পরিদর্শনে যান দুর্যোগ প্রতিমন্ত্রী মহিববুর রহমান। এসময় ত্রাণ পেয়ে ক্ষতিগ্রস্তরা কিছুটা খুশি হলেও প্রতিমন্ত্রীর কাছে স্থায়ী বাঁধ ও সাইক্লোনশেল্টার নির্মাণের দাবী জানান। ‘ত্রাণ চাইনা, বেড়িবাঁধ চাই’ দাবী সম্বলিত পোস্টার বুকে ঝুলিয়ে তারা এ দাবী জানান প্রতিমন্ত্রীর কাছে।
রাঙ্গাবালী উপজেলার ঘূর্ণিঝড় দুর্গত এলাকা চর আন্ডা’র বাসিন্দা তুহিন হাওলাদার বলেন, সিডর, আইলা, মহসেন, ফনি থেকে শুরু করে সব ঘূর্ণিঝড় আঘাতে হেনেছে এই চরের ওপর। ২০০৭ সালে সিডরের সময় বেড়িবাঁধ বিধ্বস্ত করেছিল। এরপর আর তা মেরামত কিংবা পু:ন নির্মাণ করা হয়নি। যার কারণে সিডর পরবর্তী সকল ঘূর্ণিঝড়ে পানি ঢুকে তছনছ করে দেয় দুর্যোগের ক্ষতি পুসিয়ে উঠার আগেই চলে আসে আরেক ঘূর্ণিঝড়। যার কারণে মাছ শিকারের ওপর জীবিকা নির্ভর এই জনপদের মানুষের দরিদ্র থেকে নিস্ব হয়ে গেছে।
চর আন্ডা গ্রামের ইউপি সদস্য মো. লোকমান জানান, বিভিন্ন সময়ের ঘূর্ণিঝড়ে বিধ্বস্ত বেড়িবাঁধ পুনঃ নির্মাণ না করায়, এবারের রেমালের তান্ডবে পুরো ভেঙে যায় বাঁধ। হুহু করে পানি ঢুকে যায়। মুহুর্তেই প্লাবিত হয় পুরো এলাকা। বড় বড় ঢেউয়ের তান্ডব বাড়ি ঘরের মধ্যে থাকা সব কিছু কেড়ে নেয়। কেউ কেউ পরনের পোশাক ছাড়া ঘর থেকে অন্য কিছু রক্ষা করতে পারেনি। সহায়সম্বলহীন হয়ে বেড়িবাঁধে আশ্রয় নিয়েছেন কেউ কেউ। ঘর নির্মাণ করার টাকা না থাকায় অনিশ্চিত জীবনের মধ্যে রয়েছে ক্ষতিগ্রস্থ অনেক মানুষ।
এব্যাপারে জানতে চাইলে স্থানীয় সাংসদ ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী মো. মহিববুর রহমান জানান, রেমালের ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে সব মন্ত্রনালয়ের সমন্বয়ে কাজ চলছে। ইতোমধ্যে দুর্যোগপূর্ণ নিম্নাঞ্চলে সাইক্লোন সেল্টার নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। এছাড়া টেকসই বাঁধ নির্মাণ ও বাস্তুহারা মানুষের বাড়ি-ঘর নির্মাণে পদক্ষেপ নিতে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে কাজ চলছে। বিশেষ করে মাননীয় প্রতিমন্ত্রী এ অঞ্চলে এসে হেলিকপ্টারে চড়ে নিজ চোখে ক্ষয়ক্ষতির দৃশ্য অবলোকন করেছেন এবং সমাবেশে তিনি আশ্বাস দেন বাস্তুহারা মানুষের বাসস্থান ও ক্ষতিগ্রস্ত বাঁধ নির্মাণ করে দেয়ার। এরপরই সব মন্ত্রণালয়ের সমন্বিত কাজ শুরু হয়েছে। দ্রুত সময়ের সব সমস্যা সমাধান হবে।